আড়াই মাসের যমজ শিশু দীপা-নীপার জ্বর হয়েছে। মা পুষ্পরানী তাদের নিয়ে এসেছেন এলাকায় হঠাৎ আবির্ভূত আমজাদ ফকিরের কাছে। আমজাদ দেখেই বললেন, শিশু দুটিকে ভূত-পেত্নিতে একসঙ্গে ধরেছে। ততক্ষণে পুষ্পরানী দেখলেন অন্য কয়েকটি শিশুকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। শিশুদের বুকফাটা কান্না দেখে পুষ্পরানী যমজ দুই মেয়েকে নিয়ে ফকিরের আস্তানা ছেড়ে যেতে বাইরে পা বাড়ান। সঙ্গে সঙ্গে আমজাদের দুই সহযোগী মনজিল ও সুরত আলী তাঁর কোল থেকে শিশু দুটিকে ছিনিয়ে নেন। এরপর আমজাদ এগিয়ে এসে প্রথমে শিশু দুটির পা কাপড় দিয়ে বেঁধে খুঁটিতে ঝুলিয়ে দেন। শিশুরা বুকফাটা কান্না শুরু করে। আমজাদের সহযোগীরা শিশুদের মাকে সরিয়ে নিয়ে যান। আধা ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখার পর পায়ের বাঁধন খুলে তাদের নামানো হয়। এরপর আমজাদ দুই হাতে দুই শিশুর পা ধরে চারদিকে চরকার মতো ঘোরাতে থাকেন। ঘোরানো শেষ হলে শিশু দুটিকে মাটিতে ফেলে প্রথমে লাথি মারতে মারতে উঠানের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত নেন আমজাদ। আতঙ্কে ও ব্যথায় চিৎকার করতে করতে প্রস্রাব করে দেয় শিশুরা। আতঙ্কিত এক শিশু আমজাদের লুঙ্গি খামচে ধরে। সবশেষে আমজাদ আড়াই মাসের শিশু দুটির পেটের ওপর উঠে দাঁড়ান। শিশুদের তখন কান্নারও শক্তি নেই। শিশুরা আবার প্রস্রাব করে দিলে ছেড়ে দেন আমজাদ।
ভন্ড আমজাদের অপচিকিৎসার কিছু ছবি দেখুন:
মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার খাসনগর গ্রামে অনেক দিন ধরে চলছিল এই বিকৃত চিকিৎসা। রোগীদের বেশির ভাগ নারী ও শিশু। কথিত এই পীরের নাম আমজাদ হোসেন বেপারি। গ্রামের লোকজন বলে ফকির। এক সময় আমজাদ ভ্যানে করে গ্রামে সবজি বিক্রি করতেন।
চিকিৎসার নামে আমজাদ চরম নির্যাতন করতেন ছোট্ট শিশুদের। সব অসুখ তাঁর কাছে জিন-ভূতের আছর। তরুণী থেকে বয়স্ক নারী—সবাইকে তিনি মোটা বেত দিয়ে পেটাতেন। মাটিতে ফেলে লাথি মারতেন। পুরুষদের চিকিৎসা চড়-থাপড়-লাথি।
প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে লাঠিপেটা শুরু হত, চলত দুপুর দেড়টা পর্যন্ত। বেলা তিনটায় শুরু হত সন্ধ্যায় খানিক বিরতির পর মধ্যরাত পর্যন্ত চলত এই বর্বরতা। আমজাদের ‘অমানবিক চিকিৎসায়’ যেকোনো রোগ ভালো হয়—লোকমুখে এমন প্রচার শুনে লোকজন সেখানে ভিড় করছে।
নতুন বাকতারচর গ্রাম থেকে এনামুল হক এসেছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন মা জরিনাকে নিয়ে। আমজাদ দেখেই বললেন, ‘ভূত ও জিন দুটোতেই ধরেছে।’ তাঁকে আমজাদের আস্তানায় রাখা হয়। সকাল-বিকেল দুই বেলা অচেতন না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে লাঠিপেটা করে আমজাদ। সাত দিন এই প্রহার চলবে বলে আমজাদ ঘোষণা দেয়।
রাতে ভূতের চিকিৎসার জন্য বাড়ির উঠানে আসর সাজাতেন ধূর্ত আমজাদ। ঢোল, খোল, হারমোনিয়ামসহ থাকত বাদক দল। বাদ্যযন্ত্রের উচ্চ শব্দের মধ্যে সব বয়সের নারী রোগীদের এনে মেঝেতে আছড়ে ফেলা হত। এরপর চলত উপর্যুপরি লাথি, লাঠিপেটা ও চড়-থাপ্পড়। মারধর শেষে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে আমজাদ নিজে নাচতেন এবং রোগীদেরও নাচতে বাধ্য করতেন।
কোন রোগী এই আসরে অংশগ্রহণ করতে না চাইলে তাকে আমজাদের সহযোগীরা টেনেহিঁচড়ে আসরে আনতেন। ঢোল, খোল, হারমোনিয়ামসহ নানা বাদ্যযন্ত্রের উচ্চ শব্দের মাঝে নারীর চিৎকারের শব্দ হারিয়ে যেত। তাঁকে ফকিরের সামনে এনে আছড়ে ফেলা হত। এরপর লাথি আর মোটা বেত দিয়ে পেটানো হত।
এরপর যে মেয়েকে আনা হলো, তিনি অবস্থা দেখে নিজেই এলোপাতাড়ি নাচতে শুরু করলেন। নাচ শেষে রোগীর কাছে আমজাদের প্রশ্ন, ‘তুই কী চাস?’ কিছুক্ষণ পর নিজেই জবাব দেন, জিন আরও নাচ দেখতে চায়। এরপর মেয়েটিকে নিয়ে নাচতে শুরু করেন আমজাদ।
আমজাদ বেপারি বলেন, ‘রোগী আসার আগেই আমি আন্দাজ পাই, কার চিকিৎসা কীভাবে করতে হবে। ছোট বাচ্চাকে পারাইছি। ফুটবলের মতো শট দিছি। আবার দেখেন পাও বাইন্ধা ঝুলাইয়া রাখছি। পাও ধইরা ঘুরাইছি। এ সবই আল্লাহর ইশারা। উনি বলে দেন, কোন রোগীর জন্য কী করতে হবে। এটাই হলো আমাদের আধ্যাত্মিক জগত্।’
শিশুদের ঝুলিয়ে রাখার বিষয়ে আমজাদ বলেন, ‘বাচ্চাদের মধ্যে শয়তানের আছর থাকে। এ জন্য ঝুলিয়ে রাখতে হয়।’ কেউ কি ভালো হয়েছে—জানতে চাইলে আমজাদের জবাব, ‘রোগ সারানোর মালিক আল্লাহ। আল্লাহ আর আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।’
আমজাদের খাদেম মনজিল জানান, এই চিকিৎসায় মারধরের পর সরষের তেলই প্রধান ওষুধ। তবে এখন তিনি ডাব, মুরগি ও ডিমপড়া দিতেন। সন্তান না হলে ডিমপড়া আর ক্যানসারের জন্য ডাবপড়া দেওয়া হত।
সরষের তেলের সঙ্গে ডাব, ডিম দিচ্ছেন কেন—জানতে চাইলে আমজাদ অর্ধেক বাংলায় ও ভুল ইংরেজিতে বলেন, ‘আল্লাহ আমারে একটা জিনিস দিছে। জিনিসটা ভালা না মন্দ, তাই জাস্টিভিট (জাস্টিফাই) কইরা দেখতাছি।’
রোগীদের মারধরের পর আমজাদ সরিষার তেল খাইয়ে দিতেন। বাড়ির উঠানের এক কোণে সরষের তেলের দোকানও বসত।
রিকশাচালক থেকে ভণ্ড পীর: আমজাদ জানান, তাঁর বয়স ৩৫ বছর। অক্ষরজ্ঞান নেই। প্রায় ১০ বছর কুয়েতে ছিলেন। প্রতিবেশীরা জানান, কিছুদিন আগেও আমজাদ গ্রামে ঘুরে ঘুরে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করতেন। জানতে চাইলে আমজাদ বলেন, ‘তখন কেউ আমাকে ইজ্জত দিত না। অহোন পীর মানে।’
আমজাদের বাবা নাজির আলী দুই বছর আগে আত্মহত্যা করেছেন। মা সানোয়ারা বাড়িতেই থাকেন। আমজাদ চার কন্যাসন্তানের জনক। এই ভয়াবহ চিকিৎসা প্রতিদিন আমজাদের মা, স্ত্রী এবং সন্তানেরাও দেখত।
নারী-শিশুদের ওপর ছেলের এই নির্মম নির্যাতনের বিষয়ে কিছু বলতে বললে আমজাদের মা বলেন, ‘বাড়িতে অনেক লোকের সমাগম হয়, হয়তো ছেলে কিছু পাইছে।’
তাঁর পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে তাদেরও কি এই একই চিকিৎসা করবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে আমজাদ বলেন, ‘হ্যাঁ’।
জানামতে, অবশেষে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আমজাদের এই অপচিকিৎসা বন্ধ হয়। কিন্তু সারা দেশে এ রকম আরো অনেক কু-চিকিৎসার প্রচলন আছে এবং দিন দিন আরো হচ্ছে। এ দেশের মানুষ যত বেশী সচেতন হবে, এ সব ভন্ডামী তত কমবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
আজব মানুষের কান্ডকারখানা
ডাক্তার নিজেতো সর্ম্পূন ভাবে মানসিক ভারসম্যহীন